Guardian Publications
Guardian Publications
May 29, 2025 at 06:40 AM
হজ ইসলামের পঞ্চম খুঁটি একজন মুসলিমের ওপর যেসব ইবাদত ফরজ, হজ তার মধ্যে অন্যতম প্রধান। এ ছাড়াও এটি ইসলামের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন। এই ইবাদতটির ব্যাপারে বেশ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে আল্লাহর কিতাব ও নবির সুন্নাহয়। ইসলামি শরিয়ায় মানুষের ওপর ফরজ করা পাঁচটি ইবাদতের সর্বশেষটিই হজ। প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির ওপর জীবনে একবার হজ সম্পন্ন করা অবশ্যকর্তব্য। প্রথমবারের পর কেউ হজ সম্পন্ন তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। হজ একটি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত। একদিকে নামাজ ও রোজা হচ্ছে শারীরিক ইবাদত। জাকাত কেবলই আর্থিক। অন্যদিকে হজ একই সাথে আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত হিসেবে পরিগণিত। এ ইবাদত পালন করতে গিয়ে বান্দার দেহ ক্লান্ত হয়। তাকে সহ্য করতে হয় সফরের কষ্ট ও ভোগান্তি। হজের মানাসিক পালন করতে মিনা, আরাফা, মুজদালিফা ইত্যাদি স্থানে অবস্থান করতে হয়। তাওয়াফ ও সায়ি করতে হয়। এর বাইরে মক্কায় যাওয়া এবং সেখানে অবস্থানের জন্য প্রচুর অর্থও খরচ করতে হয় একজন বান্দাকে। হজের মানাসিক অন্য হাজিদের সাথে সম্মিলিতভাবে পালন করতে হয়। কারণ, এগুলো পালনের সময় কয়েকটি দিনে সুনির্দিষ্ট। যেমন: তারবিয়ার দিন তথা জিলহজ মাসের আট তারিখে মিনার উদ্দেশে যাত্রা, নবম তারিখে আরাফার ময়দানে অবস্থান, নবম তারিখের সূর্য ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে ছুটে আসতে হয় মুজদালিফার উদ্দেশে। অর্থাৎ রাতেই মুজদালিফায় এসে পৌঁছতে হয়। আর দশম তারিখে করতে হয় বড়ো জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ এবং তাওয়াফে ইফাজা তথা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ। আর কেউ দশ তারিখেই হজের কার্যাবলি সমাপ্ত করতে আগ্রহী হলে সেদিন তাকে অন্যান্য জামরাগুলোতেও কঙ্কর নিক্ষেপের কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এসব কাজই করতে হয় সম্মিলিতভাবে। আর তা মুসলমানদের কাছে আল্লাহর ইবাদত হিসেবে গণ্য। আর এসব পালন করা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবেও ইসলামে স্বীকৃত। মুসলমানদের জন্য হজটা একধরনের আত্মসমর্পণের প্রশিক্ষণের সাথে তুল্য। এ সময় তাদের জন্য যেকোনো ধরনের শিকার করা, গাছ কাটা বা কোনো কিছু উপড়ানো নিষিদ্ধ। এটা সাম্যেরও প্রশিক্ষণ। কারণ, এ সময় সবাইকেই একই ধরনের সাদা কাপড় পরিধান করতে হয়, যা বিনম্রতা প্রকাশক। ফলে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে কোনো তফাত থাকে না। তফাত থাকে না শাসক ও শাসিতের মাঝেও। হজের জন্য কেবল বিশুদ্ধ হালাল সম্পদই ব্যয় করতে হয়। আর তা আদায় করতে হয় একিন ও ইখলাসের সাথে। এটি সম্পাদনের পর মুসলমানরা যেন নতুন জন্মগ্রহণ করা নিষ্পাপ শিশু হয়ে যায়। ফলে সে নিজ দেশে ফিরে আসে এক অন্য মানুষ হয়ে। যেমনটা বলেছেন-'যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করল এবং অশালীন কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল, সে ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ থেকে ফিরে আসবে, যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল। '২১৫ (সহিহ বুখারি :১৫২১; সহিহ মুসলিম ১৩৫০) জিলহজ মাসের দশ তারিখে ঈদুল আজহাও উদ্যাপিত হয়। এটি মুসলমানদের কাছে দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈদ। এ ঈদ হজের ইবাদতের সাথেই সংযুক্ত। এ কারণেই জিলহজ মাসের দশ তারিখকে হজুল আকবার নামেও অভিহিত করা হয়। নবিজি সারাজীবনে কেবল একবার হজ করেছেন। এর বাইরে তিনি আর কোনো হজ করেননি। আর তা করেছেন দশম হিজরিতে। এ হজে হাজিদের উদ্দেশে তিনি এমন এক ভাষণ দিয়েছেন, যা সাধারণ খুতবার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। এ খুতবায় তিনি হজের মানাসিক বর্ণনা করেছেন। দ্বীনের সাধারণ উসুল ও মূলনীতিগুলোও। আরাফার ময়দানে প্রদত্ত এ খুতবায় তিনি মানুষ ও মানবতার অধিকারের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-'তোমাদের পরস্পরের রক্ত ও সম্পদ পরস্পরের জন্য হারাম; যেমন আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহর তোমাদের জন্য হারাম ও সম্মানিত। জেনে রেখো, জাহেলি যুগের সকল প্রথা আজ আমার পায়ের তলায় পদদলিত হলো। জাহেলি যুগের সকল রক্তপণও বাতিল ঘোষিত হলো। সর্বপ্রথম আমি আমাদের প্রাপ্য ইবনে রবিয়া ইবনে হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের রক্তপণ বাতিল করছি। ২১৬ (ইবনে রাবিয়া ইবনে হারিস বনি সাদ গোত্রে প্রতিপালিত হওয়অর সময় হুজাইল গোত্র তাকে হত্যা করেছিল)- অতএব, আজকের পর থেকে কেউ জাহেলি যুগের কোনো রক্তপণ দাবি করতে পারবে না। জাহেলি যুগের সুদ প্রথাকেও আমি বাতিল ঘোষণা করছি। আর সর্বপ্রথম আমি আমাদের প্রাপ্য আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদকে রহিত ঘোষণা করছি। তাঁর প্রাপ্য সকল সুদ মওকুফ করা হলো।' এরপর নবিজি নারীদের প্রতি কল্যাণকামী হওয়ার উপদেশ দিয়ে বলেন-'হে আল্লাহর বান্দারা, নারীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। কারণ, তোমরা তাদের আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ। আল্লাহর নামে মোহর দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের জন্য তাদের হালাল করেছ। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হলো-তোমাদের বিছানায় তারা এমন কাউকে আসতে দেবে না, যাদের তোমরা অপছন্দ করো। যদি তারা এমন কাজ করে, তাহলে মৃদু প্রহারের মাধ্যমে তাদের শাসন করো। আর তোমাদের ওপর তাদের অধিকার হলো, ন্যায়সংগতভাবে তাদের খাদ্যের ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।'২১৭ (সহিহ মুসলিম১২১৮ ; আবু দাউদ: ১৯০৫) ইয়াওমুন নহর তথা কুরবানির দিন এ বিষয়টিকে নবিজি আরও সুদৃঢ় করেন। নবিজি জিজ্ঞেস করলেন, কোন দিনটি সবচেয়ে বেশি সম্মানিত? লোকেরা উত্তর দিলো, আজকের এই দিন। তিনি আবার বললেন, কোন মাস সবচেয়ে বেশি সম্মানিত? লোকেরা বলল, চলমান এই মাস। তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, কোন শহর সবচেয়ে বেশি সম্মানিত? লোকেরা বলল-এই শহর, যাতে এখন আমরা বসবাস করছি। এবার নবিজি বললেন-'নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম ও সম্মানিত। যেমন হারাম ও সম্মানিত আজকের এই দিন, এই শহর এবং এই মাস।'২১৮ (মুসনাদের আহমাদ :১৪৯৯০। মুসনাদের তাখরিজকারীগণ বলেন, হাদিসটি ইমাম বুখারি ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ। আর হাদিসটি একই অর্থগতভাবে ইমাম বুখারি ও মুসলিম ও বর্ণনা করেছেন। দ্র.সহিহ বুখারি : ৬৭; সহিহ মুসলিম : ১৬৭৯) আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলোতে নবিজি মানুষের উদ্দেশে আরেকটি ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন-'হে লোকসকল, তোমাদের প্রভু একজন। তোমাদের বাবাও একজন। আজ থেকে কোনো অনারবের ওপর আরবের এবং কোনো আরবের ওপর অনারবের বিশেষ কোনো মর্যাদা নেই। বিশেষ মর্যাদা নেই কালোর ওপর সাদার এবং সাদার ওপর কোনো কালোরও। তবে তাদের মধ্যে মর্যাদার মানদণ্ড হলো তাকওয়া। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ওই ব্যক্তি, যে সর্বাধিক মুত্তাকি। '২১৯ (মুসনাদে আহমাদ: ২৩৪৮৯) বিদায় হজে নবিজি এভাবেই সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। নবিজির এ হজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনম্রতা এবং তাঁর কাছে মুখাপেক্ষী হওয়ার মাঝে নিমজ্জমান ছিল। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, নবিজি একটি জীর্ণ জিনে সওয়ার হয়ে হজ সম্পাদন করেন। এ সময় তাঁর গায়ে ছিল একটি পোশাক। যার মূল্য চার দিরহামও হবে না। আর তিনি বলছিলেন-'হে আল্লাহ, তুমি আমার এ হজকে কবুল করো। আর এটিকে আত্মপ্রদর্শন ও সুখ্যাতি করো না।'২২০ (ইবনে মাজহ: ২৮৯০; ইমাম তিরমিজি, আশ শামাইল: ৩৩৫; শাইখ আলবানি, সহিহ ইবনে মাজাহ২৩৩৭। শাইখ আলবানি ( রহ.) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।) সুমামা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আনাস (রা.) বলেন, আনাস হাওদায় আরোহণ করে হজে গমন করেছেন। অথচ তিনি মানুষ হিসেবে কৃপণ ছিলেন না। আর তিনি এই হাদিসও বর্ণনা করেছেন, নবিজি হাওদায় আরোহণ করে হজে গমন করেছিলেন। আর সেই উটটি তাঁর জামিলাও ছিল। ২২১ ( সহিহ বুখারি: ১৫১৭) জামিলা এমন উট, যার ওপর মুসাফিরের প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয় ও অন্যান্য সামগ্রী বহন করা হয়। সাধারণত বিত্তশালীদের জামিলা ও বাহন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। অর্থাৎ তারা এক উটে আরোহণ করে সফর করে, আর ভিন্ন উটে মালপত্র বহন করে। কিন্তু বিদায় হজের সময় তিনি যে উটে আরোহণ করেছেন, সে উটেই মালপত্র নিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর বাহন ও জামিলা একই উট ছিল। এটা ছিল তাঁর বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ। হিজরতের পর নবিজি মোট চারবার উমরা করেছেন। আনাস (রা.) বলেন-'নবিজি মোট চারবার উমরা পালন করেছেন। তিনি হজের সঙ্গে যে উমরাটি পালন করেন, তা ব্যতীত সব কটিই সম্পন্ন করেছিলেন জিলকদ মাসে। হুদাইবিয়ার বছরের উমরাটি ছিল জিলকদ মাসে। হুদাইবিয়ার পরের বছরের উমরাটি ছিল জিলকদ মাসে। হুনাইনের প্রাপ্ত গনিমত যে জিরানা নামক স্থানে বণ্টন করেছিলেন, সেখানের উমরাটিও ছিল জিলকদ মাসে। এর বাইরে তিনি হজের সঙ্গে একটি উমরা পালন করেন।'২২২ (সহিহ বুখারি: ৪১৪৮; সহিহ মুসলিম : ১২৫৩) বিদায় হজের সঙ্গে নবিজি যে উমরাটি করেন, তার জন্য ইহরামও জিলকদ মাসেই পরিধান করেছিলেন। তবে এ উমরার কার্যাবলি সম্পন্ন করেন জিলহজে। কারণ, তিনি দশম হিজরিতে জিলকদ মাসের পাঁচ দিন অবশিষ্ট থাকতে মদিনা থেকে যাত্রা করেছিলেন। আর মক্কায় এসে পৌঁছেছিলেন জিলহজ মাসের চার তারিখে।

Comments