🕌 "দেওবন্দিয়ত, একটি চিন্তাধারা এবং শুধু 'মুসলমান' হিসেবে পরিচয় দেওয়ার বিভ্রান্তি" ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান যা প্রতিটি যুগে পথনির্দেশ করে। কিন্তু ইসলামের সঠিক জ্ঞান অর্জন এবং তা কার্যকর করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগ পরবর্তী সময়ে জ্ঞান ও ফিকহের যে ধারাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলোকে 'মাকতাব-এ-ফিকর' বা চিন্তাধারা বলা হয়। আজ কিছু লোক প্রশ্ন করে: "আপনারা দেওবন্দী কেন? শুধু মুসলমান কেন নন?" এই প্রশ্নটি আসলে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রান্তির ফল, যা 'ফিরকা' (সম্প্রদায়/দলাদলি) এবং 'মাকতাব-এ-ফিকর' (চিন্তাধারা/স্কুল অব থট)-এর পার্থক্য না বোঝার কারণে সৃষ্টি হয়। 🔹 ফিরকা এবং মাকতাব-এ-ফিকরের পার্থক্য পবিত্র কোরআন উম্মতকে ফিরকায় বিভক্ত হতে নিষেধ করেছে: > "وَلاَ تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ * مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا..." > (সূরা রুম: ৩১-৩২) > এই আয়াতে সাম্প্রদায়িকতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে; অর্থাৎ, এমন একটি দল তৈরি করা যা ধর্মের মূলনীতি থেকে সরে এসে নিজেদের জন্য আলাদা পথ তৈরি করে। অন্যদিকে, 'মাকতাব-এ-ফিকর' এর অর্থ হলো: > "ধর্মকে বোঝা এবং তার উপর আমল করার একটি নির্দিষ্ট জ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা শরীয়তের নীতির মধ্যে থাকে।" > উদাহরণস্বরূপ: * ফিকহী মাকতাব-এ-ফিকর: হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী, হাম্বলী * আক্বীদা সংক্রান্ত মাকতাব-এ-ফিকর: আশ'আরী, মাতুরিদী এগুলো সবই ইসলামের মধ্যে ধর্মীয় উপলব্ধির নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি, কোনো বিভ্রান্ত দল (ফিরকা) নয়। 🔹 দেওবন্দিয়ত কী? দেওবন্দিয়ত মূলত হানাফী মাকতাব-এ-ফিকরের মধ্যে একটি সংস্কারমূলক ও জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন, যা ১৮৬৬ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শুরু হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল: * বিশুদ্ধ তাওহীদের দাওয়াত * বিদ'আত ও কুসংস্কারের বিরোধিতা * নবী (সা)-এর সুন্নাহর অনুসরণ * তাসাউফ (আধ্যাত্মিকতা)-এর সংস্কার * ফিকহ ও উসূলের শিক্ষা দেওবন্দিয়ত কোনো নতুন ধর্ম বা ফিরকার নাম নয়, বরং কুরআন ও হাদীস এবং ফিকহ-এ-হানাফীর আলোকে ইসলামকে বোঝা ও তার উপর আমল করার নাম। যখন কেউ বলে: > "আমি দেওবন্দী" > এর অর্থ হলো: > "আমি সেই জ্ঞানভিত্তিক ও সংস্কারমূলক উপলব্ধির ধারায় ধর্ম গ্রহণ করি, যা দেওবন্দের উলামাগণ উম্মতের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।" > 🔹 শুধু "মুসলমান" হিসেবে পরিচিত হওয়ার দাবি কিছু লোক বলে: "আমরা দেওবন্দী নই, বেরেলভী নই, আহলে হাদীসও নই — আমরা শুধু মুসলমান।" এই কথা শুনতে ভালো লাগে, তবে এর মধ্যে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রান্তি রয়েছে: ১. এই দাবি আত্মপরিচয় অস্বীকারের উপর ভিত্তি করে গঠিত। ধর্মকে বোঝার কোনো না কোনো পদ্ধতি প্রত্যেকের কাছে থাকে। যখন একজন ব্যক্তি কোনো নির্দিষ্ট বুঝকে মেনে নেয় কিন্তু নাম অস্বীকার করে, তখন সে আসলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক নীতিগুলো গোপন করছে। ২. এই দাবি প্রায়শই একটি সুপ্ত সমালোচনা হয়, অর্থাৎ যেন বাকি সবাই নিজেদের দলে বিভক্ত করে ফেলেছে, আর শুধু তারাই সত্যের উপর আছে। এটি আসলে 'অক্স-এ-নাকিজ' (বিপরীত প্রতিচ্ছবি)-এর ভুল ব্যবহার: > "যদি আমি শুধু মুসলমান হই, তাহলে দেওবন্দী, বেরেলভী বা আহলে হাদীস কি মুসলমান নয়?" > এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের অস্বীকারের দিকে নিয়ে যায় এবং উম্মতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। 🔹 কেন দেওবন্দিয়তের প্রয়োজন হয়েছিল? ফিকহ-এ-হানাফীর অনুসারীদের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী এমনও ছিল যারা: * বাড়াবাড়ি অবলম্বন করেছিল * ওলীদের সম্পর্কে বাড়াবাড়ি পূর্ণ বিশ্বাস পোষণ করেছিল * নবী (সা)-এর প্রতি ভালোবাসায় শিরকী বাক্য ব্যবহার করতে শুরু করেছিল * ধর্মে নতুন বিদ'আত সৃষ্টি করেছিল এদের থেকে পার্থক্য ও দূরত্ব বজায় রাখার জন্য হক্কানী উলামাগণ বললেন: > "আমরা দেওবন্দী" > অর্থাৎ, আমরা সেই হানাফিয়াতের অনুসারী যা বাড়াবাড়ি, বিদ'আত এবং সীমালঙ্ঘন ও ত্রুটিমুক্ত, এবং যা কুরআন ও সুন্নাহর মানদণ্ডে প্রতিষ্ঠিত। > ✅ ফলাফল ও সারসংক্ষেপ * "দেওবন্দিয়ত" একটি সংস্কারমূলক জ্ঞানভিত্তিক চিন্তাধারা, কোনো আলাদা ফিরকা নয়। * শুধু "মুসলমান" হওয়া গর্বের বিষয়, তবে ধর্মকে কোন উপলব্ধি থেকে বোঝা হচ্ছে, তা স্পষ্ট করা জরুরি। * মাকতাব-এ-ফিকরের প্রকাশ সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং জ্ঞানভিত্তিক সততা। * ফিরকা হলো যা ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে আলাদা পথ অবলম্বন করে, আর মাকতাব-এ-ফিকর হলো ধর্মের মধ্যেই বোঝার বিভিন্ন দিকের নাম। 📌 গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: যেমন সাহাবা কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মতের লোক ছিলেন (যেমন: ইবনে আব্বাস (রা) এবং ইবনে মাসউদ (রা)), কিন্তু সবাই "মুসলমান" ছিলেন — তেমনি আজও বিভিন্ন চিন্তাধারা থাকতে পারে, শর্ত হলো সেগুলো সুন্নাহ ও মধ্যপন্থার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। নিশ্চিতভাবে! নিচে আপনার জন্য "তিহাত্তর ফিরকা এবং আহলে নাজাত জামাত" শিরোনামে একটি ব্যাপক, সুচিন্তিত এবং জ্ঞানভিত্তিক নিবন্ধ উপস্থাপন করা হচ্ছে। তিহাত্তর ফিরকা এবং আহলে নাজাত জামাত ✒️ রচনা: মুসলিম উম্মাহতে সাম্প্রদায়িকতার আলোচনা কোনো নতুন বিষয় নয়। আজকের যুগে যখন ইসলাম-বিরোধী শক্তিগুলো মুসলমানদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক, ভৌগোলিক এবং মাসলাকভিত্তিক বিভেদ সৃষ্টি করছে, তখন এই প্রশ্নটি মনে তীব্রভাবে জাগে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যে তিহাত্তরটি ফিরকার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তারা কারা? তাদের পরিচয় কী? এবং কোন দলটি জান্নাতি? এই প্রশ্নটি, যদিও বাহ্যিকভাবে ঐতিহাসিক মনে হয়, তবে এর সম্পর্ক সরাসরি আমাদের বিশ্বাস, পদ্ধতি এবং মুক্তি (নাজাত)-এর সাথে। 🔹 উম্মতের বিভেদ সম্পর্কিত হাদীস: নবী করীম (সা) বলেছেন: "আফতারাখাতিল ইয়াহুদু আলা ইহদা ওয়া সাব'ইনা ফিরকাতিন, ওয়া আফতারাখাতিন নাসারা আলা ইছনাতাইনি ওয়া সাব'ইনা ফিরকাতিন, ওয়া সাতাফতারিকু উম্মাতী আলা সালাছিন ওয়া সাব'ইনা ফিরকাতিন, কুল্লুহা ফিন নারি ইল্লা ওয়াহিদাতিন।" "ইহুদিরা ৭১টি দলে বিভক্ত হয়েছিল, নাসারারা ৭২টি দলে, এবং আমার উম্মত ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে, তাদের সবাই জাহান্নামী হবে একটি ব্যতীত।" 📗 (সুনানে আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) 🔸 আহলে নাজাত কারা? সাহাবাগণ (রা) আরজ করলেন: "হে আল্লাহর রাসূল! সেই মুক্তিপ্রাপ্ত দলটি কারা?" তিনি (সা) বললেন: "মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী" "আমি এবং আমার সাহাবাগণ যে পদ্ধতির উপর আছি।" অর্থাৎ, আহলে নাজাত তারাই হবে: * যারা কুরআন ও সুন্নাহকে ভিত্তি বানাবে * সাহাবাগণ (রা) এবং সালাফ-এ-সালেহীনদের (পূর্ববর্তী নেককারদের) পদাঙ্ক অনুসরণ করবে * বিদ'আত, বাড়াবাড়ি এবং বাতিল ব্যাখ্যা থেকে বাঁচবে এদেরকেই "আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আত" বলা হয়, যাদের মূল ভিত্তি কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবাদের ইজমা (ঐকমত্য) এবং মধ্যপন্থা। 🧠 ফিকহী মাকতাব-এ-ফিকর 'ফিরকা' নয় আজ কিছু অবুঝ লোক প্রশ্ন করে যে, "যখন হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী, হাম্বলী বিদ্যমান, তখন তারা কি ৭৩টি ফিরকার অংশ নয়?" এটি একটি বিরাট বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণা। * ফিকহী মাকতাব-এ-ফিকর হলো ধর্মকে সুসংবদ্ধ নীতিমালার সাথে বোঝা এবং আমল করার ইজতিহাদী প্রচেষ্টা। * এগুলো সবই আকীদাগতভাবে একমত। * কেবলমাত্র ফুরয়ী (শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত) ইজতিহাদগুলিতে তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। * তাদের মধ্যে কেউই কুরআন বা সুন্নাহ অস্বীকারকারী নয়। সুতরাং, এগুলো ফিরকা নয়, বরং ধর্মীয় চিন্তার বিভিন্ন স্কুল (Schools of Thought)। এগুলো সবই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতেরই অংশ। 🔥 আসল ফিরকাগুলো কোনটি? আহল-এ-ইলম (জ্ঞানী ব্যক্তিগণ) কুরআন ও হাদীস, সালাফদের নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থ অনুযায়ী এই ৭২টি পথভ্রষ্ট ফিরকাকে ১০টিরও বেশি বড় গ্রুপে ভাগ করেছেন, যাদের উপ-শাখাগুলো মোট ৭২টিতে পৌঁছেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফিরকাগুলো নিম্নরূপ: | বড় গ্রুপ | প্রসিদ্ধ শাখা-প্রশাখা | |---|---| | খাওয়ারেজ | আজারিকাহ, নাজদাত, সাফরিয়াহ, ইবাদিয়াহ, আজারদাহ | | রাওয়াফিজ (গালি শিয়া) | ইসনা আশারিয়াহ, ইসমাইলিয়াহ, নুসাইরিয়াহ, যাইদিয়াহ, কাইসানিয়াহ | | মু'তাজিলাহ | নিজামিয়াহ, জাহিজিয়াহ, আমরিয়া, হাদ্দিলিয়াহ, আসমিয়া | | মুরজিয়াহ | ইউনুসিয়ান, ঘাসানিয়াহ, আম্মারিয়াহ | | ক্বাদেরিয়াহ ও জাবারিয়াহ | মা'বাদিয়াহ, জাহামিয়াহ, দারারিয়াহ, সালিমিয়াহ | | বাতিনিয়াহ ও গুলাত | কারামিতাহ, দ্রুজ, হুলুলিয়াহ, ইত্তেহাদিয়াহ | | হাদীস অস্বীকারকারী / লিবারেলস | কুরআনিয়াহ, প্রগ্রেসিভ ইসলাম, সেক্যুলার গ্রুপ (আধুনিক যুগের বিচ্যুতি) | 📌 এদের প্রতিটি দলই ধর্মের কোনো না কোনো মৌলিক শিক্ষায় বাড়াবাড়ি বা অস্বীকার করেছে — কেউ কেউ আল্লাহর গুণাবলীতে, কেউ কেউ সাহাবাদের মর্যাদায়, কেউ কেউ ওহীর উপর বুদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়েছে, এবং কেউ কেউ ফুরয়ী (শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত) মতভেদকে ধর্মের ভিত্তি বানিয়ে ফেলেছে। ✅ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আত: একমাত্র পদ্ধতি, ব্যাপক পরিধি জান্নাতি ফিরকা তারাই: * যারা কুরআন ও সুন্নাহর উপর "ফাহম-এ-সাহাবা" (সাহাবাদের বুঝ) অনুযায়ী আমল করে। * যারা বিদ'আতকে ঘৃণা করে এবং সুন্নাহকে ভালোবাসে। * যাদের পদ্ধতি মধ্যপন্থা, জ্ঞান, ধৈর্য এবং ইখলাসের উপর ভিত্তি করে গঠিত। * যারা ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, এবং ইমাম আহমদ এর মতো সত্যপন্থী আলেমদের অন্তর্ভুক্ত। 🏁 উপসংহার: ইতিহাস সাক্ষী যে, প্রতিটি গোষ্ঠী যারা বুদ্ধিবৃত্তিক অহংকার, দলীয় গোঁড়ামি, বা ধর্মীয় বিচ্যুতিতে আক্রান্ত হয়েছে, তারা শেষ পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আত সেই নৌকা যা প্রতিটি তুফানে নিরাপদ ছিল — কারণ এটি কুরআন ও সুন্নাহকে ভিত্তি করে, সাহাবাদের আলোকেই ধর্মকে বোঝে এবং বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকে। সুতরাং, এটা জরুরি যে আমরা নিজেদেরকে জ্ঞান, ইখলাস এবং মধ্যপন্থার সাথে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করি — নামের, দলগুলোর, বা ফাঁকা দাবির দিকে নয়। 📿 "আল্লাহুম্মা ইজ'আলনা মিনাল ফিরকাতিন না'জিয়াহ, ওয়া লা তাজ'আলনা মিনাল হালিকিন" (হে আল্লাহ! আমাদেরকে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত করুন, এবং আমাদেরকে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না।) ✍️ লেখক: মুহাম্মদ আকিল কাসেমী, খাদেম মাদ্রাসা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ দাহানা