Suprokash
Suprokash
February 6, 2025 at 11:01 AM
"অবশ্য উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধে কর্মী-নিয়োগের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য প্রেস-ঘনত্ব কলকাতা ছাড়াও ভারতের আরও অনেক শহরই দাবি করতে পারে। যেমন উত্তর কর্ণাটকের গদাগ (? গদগ)। সুপরিচিত সাংবাদিক সঙ্গামেশ মিনাসিনাকাই (?) (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২২ জানুয়ারি ২০২৪) জানাচ্ছেন যে, গদাগ শহর নিয়ে এমন প্রবচন প্রচলিত ছিল যে, সেখানে একটি ঢিল ছুঁড়লে হয় তা একটা প্রেসে, নতুবা একজন কম্পোজিটরের দরজায় গিয়ে আশ্রয় নেবে। এই শহর, এই শহরের তার ছাপাখানার জীবনের অন্তরকথা বিবৃত করতে গিয়ে আমাদের সম্পূর্ণরূপে মিনাসিনাকাই এবং রঙ্গনাথনের প্রতিবেদনের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ফলে গদাগ শহর ও অঞ্চল-সম্পর্কে আমাদের প্রদত্ত বিবরণ এতটাই পরোক্ষ যে, তা অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্তিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। মুরালি রঙ্গনাথন তাঁর 'মুদ্রণের ইতিহাস : একটি কম্পোজিটরের গল্প—ত্বরিতা মুদ্রা বা গতি মুদ্রণ' নামক নিবন্ধিক-রচনায় গদাগের একটি ভৌগোলিক পরিচয় দিয়েছেন 'মিটারগেজ মাদ্রাজ ও দক্ষিণ মহরত্তা রেলওয়ের হুবলি-গুন্টকাল শাখা লাইনে অবস্থিত গদাগ, বোম্বে প্রেসিডেন্সির ছোটো শহরটির প্রতিকৃতি বলা যায়। বোম্বে-কর্ণাটক নামে পরিচিত এই অঞ্চলের অর্থনীতির প্রধান উৎস তামাক এবং তুলা। ১৯৪১ সাল নাগাদ ৫৬,০০০ জনসংখ্যাবিশিষ্ট গদাগ এই অঞ্চলের বৃহত্তর শহরগুলির মধ্যে একটি ছিল। ধারওয়াড় এই অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত হয়েছিল। হুবলি ছিল এর ব্যবসার কেন্দ্র। দক্ষিণে গিয়ে, দাভাঙ্গেরে বৃহৎ তুলা টেক্সটাইল মিল এবং তেল নিষ্কাশন মিল ছিল, অন্যদিকে গদাগে অসংখ্য বিড়ি উৎপাদন ইউনিট ছিল।... ১৯৩০ সালের মধ্যে, গদাগ বোম্বে কর্ণাটকের একটি প্রধান মুদ্রণ কেন্দ্র হিসাবে দেখা দিয়েছিল। সত্যপ্রকাশ ছাপাখানা এবং রসিকারঞ্জিনী প্রিন্টিং প্রেসের মতো কয়েকটি বড়ো ছাপাখানা ছাড়াও যেগুলি বই ও সংবাদপত্র ছাপাত, গদাগ প্রায় পঞ্চাশটি ছাপাখানা নিয়ে গর্ব করতে পারে।' (মুরালি রঙ্গনাথন : ২০২৩ ও সঙ্গামেশ মিনাসিনাকাই : ২০২৪) বস্তুত বিশ শতকের গোড়ার দিক হতে গদাগ বস্ত্র, তেল ও ময়দা কারখানার জন্য খ্যাত ছিল, কিন্তু সেসব ছাপিয়ে তার সর্বাধিক খ্যাতি সেখানকার মুদ্রণ শিল্পের জন্য। হুবলি-ধারওয়াড় অঞ্চল কর্ণাটকের সংস্কৃতি-শিল্প-শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই গদাগ মুদ্রণ শিল্পের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাচীন স্থাপত্য ও সৌধখচিত গদাগের (শহরটিতে একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দী একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ ও স্থাপত্যকীর্তি রয়েছে, এখানকার অধিকাংশ হিন্দু ও জৈন স্থাপত্যই চালুক্য রাজাদের শাসনকালে নির্মিত) মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস-পরিধি কলকাতার অবশ্য তুলনায় অনেক অর্বাচীন। ১৮৭২ সালে জ্ঞানচন্দ্রোদয় প্রেস স্থাপনার মধ্য দিয়ে গদাগে মুদ্রণশিল্পের সূচনা হয়। ১৮৮৪ সালে গদাগ থেকে প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ পায়। তার পর থেকে এখানে অনেক পত্রিকা, গ্রন্থ প্রকাশনা এবং অন্যান্য কাজের জন্য অনেক প্রেস স্থাপিত হতে থাকে। কিন্তু প্রেসের সংখ্যা বা ব্যাপকতার জন্য গদাগের খ্যাতি হয়নি, প্রিন্টিংপ্রেসের ব্যাপারে তার খ্যাতির কারণ প্রেস-কর্মী, বিশেষভাবে বিপুল-সংখ্যক দক্ষ কম্পোজিটর সরবরাহের জন্য। কথিত আছে ১৮৭২ সালে জ্ঞানচন্দ্রোদয় প্রিন্টিং প্রেসে মাকতুমসব কুন্নীভাবি (?) গদাগের প্রথম কর্মী বা কম্পোজিটর হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলেন। (সঙ্গামেশ মিনাসিনাকাই : তদেব) এর পর থেকে কয়েক দশক ধরে গদাগ ও তার যমজ শহর বলে পরিচিত বেতগিরিতে এমন কোনো বসতি এলাকার এমন কোনো রাস্তা ছিল না যেখানে একজন না একজন কম্পোজিটর বাস না করতেন। কর্ণাটকের হুবলি, ব্যাঙ্গালোর, রায়চুর, বিজাপুর ইত্যাদি শহরে এবং কর্ণাটক সংলগ্ন হায়দরাবাদের মুদ্রণ শিল্পে এই শহরের কম্পোজিটরদের বিরাট চাহিদা ছিল। গদাগের কম্পোজিটরদের বিপুল খ্যাতি এবং কর্মকুশলতা সম্পর্কে আমরা অনেক কথা জানতে পারি ফকীরসা শিবান্নাসা (?শিবনাসা) ভান্দাগে (?ভান্দেগে/ভন্তেজ/ভন্তেজে) (১৯৩১- ২০০৯)-র আত্মজীবনী 'ইয়ারু নানু? জীবনা কথানা' (হু অ্যাম আই? এ লাইফ স্টোরি) থেকে। কন্নড় ভাষায় লেখা এই অভূতপূর্ব প্রেসকথা বা একজন কম্পোজিটরের অন্তরকথাটি গ্রন্থাকারে আমাদের পক্ষে পাঠ করা সম্ভব না-হলেও 'প্রিন্ট উইক'-এর ই-পাতায় ভারতের মুদ্রণ ইতিহাসের স্বীকৃত অন্বেষক মুরালি রঙ্গনাথনের করা আলোচনা ('প্রিন্ট হিস্ট্রি : এ কম্পোজিটর'স টেল-ত্বরিত মুদ্রাণা অর স্পিড প্রিন্টিং) থেকে গ্রন্থটির সারমর্ম আমরা জ্ঞাত হতে পারি। কন্নড় ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এই চমৎকার আলোচনাটিকে আমাদের প্রায় রঙ্গনাথনের ভাষাতেই উপস্থাপিত করতে হবে। ১৯২১ সাল নাগাদ গদাগে বিদ্যুৎ এসে পড়ায় ১৯৩০ সালের মধ্যেই গদাগ কর্ণাটকের একটি প্রধান মুদ্রণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, গদাগের প্রেসগুলি সকলেই বৈদ্যুতিকীকরণের সুযোগ গ্রহণ করতে পেরেছিল। কেননা, অনেক লেটারপ্রেসের ট্রেডল মেশিনগুলি ৪০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পায়ে প্যাডেল করেই চালানো হতো। সেই সময় থেকে গদাগের প্রেসগুলির এমন কর্মীর প্রয়োজন ছিল যাঁদের কঠোর পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় কাজ করার মতো দৃঢ়তা ও সক্ষমতা আছে। কম্পোজিটরদের অধিকাংশই শুধুমাত্র অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন, তাঁরা বড়োজোর রচনা ও মুদ্রিত কপি পড়তে পারতেন। এঁদের প্রাপ্ত সম্মান ও প্রাপ্য বেতনও যথেষ্ট ছিল না। এই কর্মীবাহিনীর মধ্যে ফকীরসা ভান্দাগের মতো কর্মীও ছিলেন যাঁরা লেখাপড়ায় মাঝারি ধরনের ভালো হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক কারণে স্কুল ছেড়ে ছাপাখানার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪০ দশকের মাঝামাঝি (বা শেষাশেষি?) সময়ে ফকিরসা প্রথমে থোত্তপাইয়া শাস্ত্রীর প্রেসের সিনিয়ার কম্পোজিটর হনুমন্তসার অধীনে ও নির্দেশনায় প্রেসের কম্পোজিং রুমে অবৈতনিক প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে যোগ দেন। ঠিক হয়—বই ছাপার জন্য টানা কম্পোজ করার মতো দক্ষতা ও দ্রুততা অর্জন করতে পারলেই তাঁকে বেতন বা পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণকালে কোনো নগদ অর্থ না-পেলেও প্রেসের পরিচ্ছন্নতা দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তাঁরই ওপর। এই কাজের জন্য তিনি সপ্তাহে দু-টাকা করে পেতেন। সে-সময় গদাগের একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কম্পোজিটর সর্বোচ্চ দিনে (দিনে? নাকি সপ্তাহে! নাকি শুধুমাত্র হেড কম্পোজিটরদের কথা বলা হচ্ছে!) ২০ আনা (দিনে ধরলে মাসে ১৫০ টাকা! বিগত শতকের চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে!) বেতন আশা করতে পারতেন। চার সপ্তাহ বা মোটামুটি এক মাসের মধ্যেই ভান্দাগে কম্পোজিটর হিসেবে বেতন পাবার উপযোগী দক্ষ হয়ে ওঠেন। এমন-কী দুপুরের খাবার সময় এবং বিকেলে চা-এর সময় বাঁচিয়ে দিনের শেষে একটি অতিরিক্ত পাতা কম্পোজ করতে শুরু করেন। দিনের কাজের শেষে ফকীরসা মুদ্রণ-কক্ষ বা মেশিন ঘরে গিয়ে ট্রেডল মেশিন চালানোর কাজ শেখেন মুদ্রাকর পুদারাপ্পার (?) কাছে। প্রথমদিকে পঞ্জিকা ছাপার মরশুমে রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিনি দু-হাজার শিট মুদ্রণ করতেন, প্রতি হাজারে মজুরি পেতেন চার আনা। ছোটো ছেলে হওয়ায় ট্রেডল মেশিনের প্যাডেলে পা পেতেন না। ফলে ফকীরসাকে একটি বাক্সের ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা দিয়ে প্যাডেলে চাপ দিতে হতো। মুদ্রণের গতি বাড়াবার জন্য প্যাডেল করার কাজে তিনি আরেকজনকে নিয়োগ করেছিলেন। এইভাবে তিনি প্রতিরাতে ছ-হাজার শিট পর্যন্ত ছাপতে পারতেন। কিন্তু পঞ্জিকার মরশুম শেষ হলে এত কাজ থাকত না—অতিরিক্ত এই রোজগার সাপ্তাহিক বারো টাকা থেকে নেমে আসত মাত্র তিন টাকায়। বেঁচে থাকার মতো অর্থ উপার্জনের জন্য লেটারপ্রেসকর্মী তথা কম্পোজিটরদের কেমন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো তা বোঝা যায় ফকীরসা ভান্দেগের জীবন থেকে।" ........................................ লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর এক বিষাদান্ত পরম্পরা অনন্ত জানা .................................... অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা সুপ্রকাশ ছবিঋণ : আন্তর্জাল
Image from Suprokash: "অবশ্য উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধে কর্মী-নিয়োগের ...
❤️ 1

Comments