
ED-Engineer's Diary
May 30, 2025 at 04:41 PM
**প্রিলি যুদ্ধ (পর্ব ২)**
আমি যখন এই লেখা শুরু করলাম, ভাবলাম প্রিলি নিয়ে হাজারটা সাজেশন লিখব। পরে হঠাৎ মনে হলো, ফেসবুকে বিসিএসে সফল মানুষ আগেই অনেক লিখেছেন। অনেক জ্ঞান দিয়েছেন। এত জ্ঞানের ভারে আমার ছোট ভাইবোনেরা হয়তো ইতিমধ্যেই ভারাক্রান্ত। আমি আর ভার না বাড়িয়ে, আমি আমার সাধ্যমত যতটুকু পারি এই লেখাতে গল্পে আড্ডায় সহজ করার চেষ্টা করি।
**আমি কিভাবে বিসিএসে এলাম?**
আব্বু সবসময় বলতেন, “তুমি বিসিএস দিবা।” আর আমি সবসময় বলতাম, “রুয়েট থেকে পাস করেই বিদেশ চলে যাব।” আমার বরাবরেরই স্বপ্ন ছিল, রুয়েট থেকে যে কোনো বরফের দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমানো। বিলাসবহুল জীবন হবে। অবাধ স্বাধীনতা— সে বয়সে কে না
এরকম জীবন চায়? সেভাবেই চলছিলাম।
কিন্তু শেষ বর্ষে এসে আমার পুরো দুনিয়াটা উল্টে গেল। পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করত না। আমি ভাবতাম, আমার সিজিপিএ রুয়েটের বিচারে মোটামুটি । চাকরি বা বিদেশযাত্রা কোন একটা হয়ে যাবে। শেষ সেমিস্টারে এক স্যার একবার ক্লাসে আমার সবার সামনে সিজিপিএ জানতে চাইলেন এবং আমার সিজিপিএ ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে বললেন “এই সিজিপিএ চাকরির বাজারে কোনো কাজে আসবে না।” তিনি আমাকে ক্লাসের সবার সামনে অপমান করার চেষ্টা করলেন। তবে স্যার জানতেন না, ততদিনে আমি 'এক কানে শুনে আরেক কানে বের করে দেওয়ার' কৌশল শিখে গিয়েছিলাম। সিজিপিএর সাথে লজ্জাও যে কমে গিয়েছিল! তবে লজ্জা কমলেও, আত্নবিশ্বাস আর স্বপ্ন দেখা কমে নি।
তবে সবসময় আত্নবিশ্বাস অটুট থাকে, তাও না। রুয়েট থেকে বের হওয়ার সময়। মনে হত, সবই করে ফেলব। আসলেও নিজেও জানি না, কি করব। আমার বন্ধু তুষার। দেখলাম বিসিএস কোচিং ভর্তি হয়ছে। কোচিং করে এসে চর্যাপদ ,শেক্সপীয়ার এগুলো প্রশ্ন বলে। কিছুই পারি না। খুব যে জানার ইচ্ছা। তাও নেই। দেখলাম, সবাই বিসিএসের দিকে যাচ্ছে। আমিও ভাবলাম। তাহলে আমি ঘুরে আসি। সে ঘুরতে গিয়ে কবে যে ভূত চেপে বসল, তা আমি নিজেও জানি না।
বিসিএস-এর ভূত যার ঘাড়ে চড়ে, তার মুক্তি নাই।** **এ যে এক বিশাল গোলকধাঁধা এবং এক অজানা গন্তব্য । এই চক্রে পড়লে বছর আর বয়স কিভাবে চলে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। আমার প্রথম বিসিএসে হয়ে গেছিল। তবুও প্রিলি প্রস্তুতি থেকে বিসিএসে জয়েনিং ০৪ বছর লেগে গেছিল।
আমাদের ২০১৬ সালের শেষ দিকে স্নাতক শেষ হয়। ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছিল ২০১৭ সালের শেষ দিকে। আমি এক বছর সময় পেয়েছিলাম প্রস্তুতি নেওয়ার। আমার সেই সময়কার প্রায় ১০০০ এর বেশি পৃষ্টার নোট সংরক্ষিত আছে । যেটা আজ শেয়ার করব। যারা প্রস্তুতি নিচ্ছ, তারা একটু সম্যক ধারণা পাবা। আমি এই নোট দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আর বিসিএস পাড় দিয়েছি। মনে রাখবা এই নোটগুলো ২০১৭ সালের। প্রায় ৯ বছর আগের। এই নোটগুলো তোমাদের ধারণা দিবে, আমি কিভাবে পড়েছিলাম।
বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য, সুশাসন—এই বিষয়গুলো তখন যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল, এখনও আছে। বাজারে যেসব ভালো বই ছিল, চেষ্টা করেছি সবগুলো থেকে নোট নিতে। ছোটবেলা থেকেই লেখকদের লেখা পড়তে পড়তে ভাবতাম, মানুষ এত সুন্দরভাবে কীভাবে মনের ভাব প্রকাশ করে! সাহিত্য আমার ভালো লাগার বিষয় ছিল। তাই আমি প্রিলি পরীক্ষা বাংলা এবং ইংরেজি সাহিত্য দিয়ে শুরু করতাম ।
**প্রিলি পরীক্ষায় কতটুকু দাগাব?** আমার এই সাজেশন বিতর্কমূলক হতে পারে, তবে যারা ইতোমধ্যে অনেক পড়েছে, তাদের কাজে আসবে। পরীক্ষায় বসলে মনে হয়—দাগাবো কি, দাগাবো না? আমি সবসময় রিস্ক নেওয়ার পক্ষেই ছিলাম। ব্যাটে লাগলে ৬, না হলে উইকেট পতন। আমি ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রায় ২০০ এর মধ্যে ১৮০টি MCQ তে উত্তর দিয়েছিলাম। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের প্রশ্ন সমাধান মিলিয়ে অনেক ভুল হয়েছিল—প্রায় ২০টির মতো। খেয়াল করে দেখ, মাইনাস মার্কিং করে প্রায় ১৫০ এর মত। নিন্দুকের এর জন্য ধরলাম ১৪০ এর মত। তবু সেফ মারকিং ১২০ এর চেয়ে অনেক বেশি । আমার মনে হয়েছিল, প্রিলির ফলাফল সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিলে কি ভালো হত! আমি রিস্ক নিতে পেরেছিলাম কারণ আমি পুরো এক বছর আমার ধ্যান ,জ্ঞান সবই প্রিলি নিয়ে ছিল। আমি দেখেছি, আমাদের অনেকেই প্রিলি পরীক্ষার পরে আফসোস করে বলে—“ভাইয়া, অনেকগুলো তো পারতাম! ইস, দাগাইলে হতো! “ আসলে তোমরা যারা অনেক প্রিপারেশন নিয়েছ, ভয় পেয়ো না। দুইটা অপশনের মাঝে কনফিউশন থাকলে, রিস্ক নিয়ে গাতে পার। পরীক্ষার পরে আফসোস করে কি হবে!
আমি প্রায় মজা করে বলি, **যা নেই খাতায়, তা নেই মাথায়**। আমি আমার বিসিএস প্রস্তুতির সময় থেকেই প্রিলির গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নোট আকারে খাতায় গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। পুরো বিশ্ব না পারলে বা না জানলেও হবে, অন্তত তোমার খাতার পয়েন্ট গুলো মনে রাখলেও হবে। আরেকটু সুন্দর করে বললে, কঠিন জিনিস না পারলেও হবে। কিন্তু সহজ জিনিস ভুল কর না।
বিসিএস যে বাংলাদেশি সমাজের কাছে একটা বড় চাকরি, তা আমি যতটা বাংলাদেশে বুঝিনি, তার চেয়ে বেশি বুঝেছি বিদেশে এসে। বিসিএস এর এক বড় ভাই আগেই বলেছিলেন, “তুমি যে বিসিএস ক্যাডার, সেটা বিদেশে বাংলাদেশি সমাজ টের না পায়।” যারা আমাকে চেনে , তারা জানে, আমি কিরকম। বিসিএস একটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা মাত্র যেটা দিয়ে আমি চাকরি পেয়েছি। এমন আহামরি কিছু না। এই যুগে যারা কাছাকাছি কাজ করে, তারা একে অন্যের তথ্য জেনেই ফেলে।
এরপর থেকে দেখি। আড্ডার মাঝে খোঁটা টাইপ কথা। ' এরা নিজেদের দেশের জমিদার ভাবে' ' এরা কেন পড়তে আসবে' ' 'হঠাৎ এত পড়ালেখার শখ কেন?' আমি আমার স্বভাবগত কারনে প্রথম দিকে চুপ ছিলাম। ঈর্ষা মানুষের স্বভাব। অন্যকে ছোট করতে পারলে আমরা অনেকেই নিজেদের বড় ভাবি।
একদিন দেখলাম আমায় বলল, 'পালায়ে আসছেন নাকি! এখন তো সব ক্যাডাররা পালাচ্ছে।' অবশেষে আমি ধৈর্য এর পরীক্ষায় ফেল করলাম। আমি ওরে বললাম, দেশে বিসিএস এর আমার সহকর্মীরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য কৃতজ্ঞ না হলেও সমস্যা নাই। কিন্তু তুমি তাদেরকে এভাবে আমার সামনে ছোট করবা না। এরপর থেকে অন্তত আমার সামনে বিসিএস ক্যাডার নিয়ে কটু কথা বলতে সাহস করে নি।
আমি ওরে বললাম, আব্বুর সাথে আমার গল্প। আব্বু কোনদিন শুনে নাই, আমি বিসিএস দিব। আমি বরাবর তোমার মত বিদেশে আসতে চাইতাম।তোমার মতই বিসিএস নাম শুনলেই এরকম মনে হত। কিন্তু জানো, আমি যখন রুয়েটে তৃতীয় বর্ষে ছিলাম, আব্বু দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। আব্বু দেখেও নাই, তার ছেলে প্রিলি দিয়েছে, রিটেন দিয়েছে, ভাইভা দিয়েছে। আমি সিওর , আব্বু এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার সময় দোয়া করে গেছে, তার ছেলে প্রথম বিসিএসে টিকবে।
আমি দেখেছি, বিসিএসে অনেকের জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করছে। বছরের পর বছর। বিসিএস দিতেই থাকে। চাকার মত। বিসিএস দিতে থেক, কিন্তু এর মাঝে নিজের জীবন ভুলো না। মনে রেখ, **বিসিএস জীবনের জন্য, জীবন বিসিএসের জন্য নয়!**
তোমরা যারা বিসিএস ক্যান্ডিডেট, তোমরা যে কষ্ট করছো, তা কেউ পুরোপুরি বুঝবে না। **তোমার পাশের মানুষটাও হয়তো বুঝবে না তুমি কিভাবে প্রতিদিন কিভাবে এক বিশাল পাহাড় পাড়ি দিচ্ছো**। আল্লাহ যেন তোমাদের কষ্ট সহজ করে দেন। তোমাদের পরিশ্রম যেন ফলপ্রসূ হয় ।
৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা সামনে । তাদের এই নোটগুলো কাজে দিবে।** **দিনের মধ্যে যতটুকু পারো, উজাড় করে দাও। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।
সব ভাইবোনদের জন্য রইলো আন্তরিক শুভকামনা ও দোয়া । ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা রইল।
https://drive.google.com/drive/mobile/folders/1fAQY_-Dl_KfnfrIwy5ZWLte1dFZlwi7O?usp=drive_link&fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR5XqHPLSsdI-bBd017szpI-wVSoNRUMY74MCP7GZUN5_iTQmMM3rywKyN4jQg_aem_YC9AidQMdL7ac9NFkaVnBQ