Suprokash
Suprokash
May 24, 2025 at 10:37 AM
১৭৩০, ১১ সেপ্টেম্বর। খেজারলি গণহ ত্যা। রাজস্থানের মারোয়াড়ের মহারাজা অভয় সিং যোধপুরের জেহনাদ সহ বেশ কিছু গ্রাম নিয়ে তৈরি এস্টেটের দায়িত্বভার দিলেন ঠাকুর সুরাট সিংকে। মহারাজার নতুন প্যালেস ফুলমহল তৈরির পরিকল্পনা করা হল। তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর চুন। চুনাপাথরের জোগান ছিল, কিন্তু সমস্যা হল সেই চুনাপাথরকে পুড়িয়ে চুন তৈরি করার জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট জ্বালানির, এবং তার জন্যেই দরকার অজস্র কাঠ, অজস্র গাছ। হাত পড়ল বিশনোই কমিউনিটির ওপর। ১৪৮৫ সালে গুরু জাম্বেশ্বরের হাতে তৈরি ২৯টি নীতির ওপর ভিত্তি করে চলা প্রহ্লাদপন্থী বা বিশনোইদের ইতিহাস, যেখানে প্রথম ও শেষ কথা পরিবেশবাদ। নিরামিষ আহার, তালাব, ট্যাঙ্ক ইত্যাদি তৈরি করে বর্ষার জল সংরক্ষণ, গাছ কে টে আগু ন জ্বা লানো আটকাতে মৃ তদেহ সৎকার না করে সমাধিস্থ করা, স্থানীয় 'ওরেন' অর্থাৎ সামাজিক বনসৃজন, বৃক্ষচ্ছেদনে নিষেধাজ্ঞা, মাটির উর্বরাশক্তি ও জলধারণক্ষমতায় প্রচণ্ড ক্ষ তি করা নীল চাষে তীব্র আপ ত্তি—একাধিক পরিবেশ-রক্ষক নীতি মেনে এসেছে বিশনোইদের গ্রাম। সুরাট সিংয়ের আদেশপ্রাপ্ত মন্ত্রী গিরিধর ভাণ্ডারীর লে ঠেল সৈ ন্যরা প্রথমেই এলেন বিশনোইদের জেহনাদে রামু বিশনয়ের বাড়ির সামনের অসংখ্য খেজরি গাছের প্লটে। এই খেজরি গাছ অর্থাৎ প্রোসোপিস সিনেরারিয়া খরা আক্রান্ত যোধপুরে বিশনোই কমিউনিটির ইতিহাস তৈরির অন্যতম ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অত্যন্ত কম জল গ্রহণ করা এবং মাটির পুষ্টিগত-ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম বাহক এই খেজরি গাছকে চিনতে ভুল করেননি জাম্বেশ্বরের উত্তরাধিকারীরা। এখনও খেজরি গাছ তাঁদের কাছে পূজ্য। সেই খেজরির ওপর হাত পড়ায় গণহ ত্যার শুরু। রামুর স্ত্রী অমৃতা দেবী বিশনোই এবং তাঁর তিন মেয়ে আসু, রত্নী এবং ভাণ্ড পরপর গাছ জড়িয়ে ধরলেন। অমৃতা বলেছিলেন—'সির সান্থে রুখ রাহে তো ভি সস্তো জান...'— যার অর্থ 'কাটা মাথা কাটা গাছের চেয়ে অনেক সস্তা'। লেঠেলধারীদের ঘুষের লো ভ, শারীরিক ব লপ্রয়োগ এবং শেষমেশ কুঠার। অমৃতা এবং তিন কন্যাসন্তানের মা থা আলাদা হয়ে গেছিল। খবর পেয়ে আশেপাশের ৮৩টি গ্রাম থেকে এলেন আরও অজস্র বিশনোই। জড়িয়ে ধরলেন এক একটি করে গাছ। পরিণতি একই। মোট ৩৬৩টি মাথা, শরীর, আলা দা। এই বীভ ৎস রক্তস্নানের খবর চলে গেছিল মহারাজা অভয় সিংয়ের কাছে। শোনা যায়, অভয় নিজে এসে ক্ষমা চান, কোনওদিন বিশনোই এবং তাঁদের খেজরি গাছের সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে ছোঁবেন না বলে শপথ নেন। সেই জেহনাদ পরে এই ঘটনার স্মরণে নাম পায় 'খেজারলি', ৩৬৩ জন স্মারকস্তম্ভ হয়ে থেকে যান। ভাদ্রের শুক্লা দশমীর রাতে অমৃতা দেবীর গ্রামে মেলা বসে। বর্তমান মনে করে অতীতকে। ২০১৩ সাল থেকে এই ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় অরণ্য শহিদ দিবস হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। পরিবেশ আন্দোলনে, পরিবেশ হ ত্যার ইতিহাসে এই বিশনোই স্রেফ এক গণহ ত্যা নয়, বরং একটি মহাকাব্য। চিপকো এবং আপিকো আন্দোলনসহ যেকোনও 'বৃক্ষ জড়িয়ে ধরো' ভাবনার শেকড়। শেকড় থেকে জমি অধিকার। পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে জমি অধিকার-রক্ষা আন্দোলন গায়ে লেগে আছে। লেগে আছে অরণ্যের অধিকার রক্ষা বা অরণ্য বাঁচাও আন্দোলন। ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড়ের ডোংরিয়া কোন্ধ আদিবাসীর লড়াইকে 'সেক্টারিয়ান' বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় এলোপাথারি আ ক্র মণের অভি যোগ এসেছে। যেমন, ২০১৬-র ২৭ ফেব্রুয়ারি ভুয়ো এনকাউন্টারে নিয়মগিরির অবৈ ধ জমি অধিগ্রহণ নিয়ে গলা ফাটানো বছর একুশের মান্ডা কাটরাকার হ ত্যা। মান্ডা সালাপি বা ক্যারিওটা ইউরেন্স গাছ থেকে পরম্পরাগত পানীয় সালাপি রস সংগ্রহ করতে গেছিলেন। এই সংগ্রহ চলাকালীন প্রাপ্য ছিল গু লি। ওড়িশারই গাঞ্জাম জেলার কুমারবন্ধ গ্রামের সওরা গোষ্ঠীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অরণ্য অধিকার নিয়ে সোচ্চার আদিবাসী আন্দোলনকর্মী আদাঙ্গু গোমাঙ্গো ছিলেন বামপন্থী অল ইন্ডিয়া কিষান মজদুর সভা এবং লোক-সংগ্রাম মঞ্চের নেতা। ২০১৬-র ২৩ মে পঞ্চান্ন বছর বয়সী নি রস্ত্র এই নেতাকে তাঁর বাড়ির বারান্দায় ঘুমের মধ্যে শে ষ করে দেওয়া হয়। অথবা ২০১৬-র ২৯ আগস্ট। ঝাড়খণ্ডের রামগড়ের গোলা অঞ্চলে গোলা পাওয়ারপ্ল্যান্ট তৈরিতে ইনল্যান্ড পাওয়ার লিমিটেডের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে প্ল্যান্টের মালিকের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছিল হাজার তিনেক স্থানীয় মানুষ। মালিকপক্ষ সামনে এলো না। হতা শ, ক্রু দ্ধ জনতাকে সামলাতে গু লি। নি হ ত দশরথ নায়েক এবং টুডু মাহাতো। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে হাজারিবাগের কাছে বাড়কাগাঁওয়ে এনটিপিসির খনি এবং তার জন্য জমি অধিগ্রহণের দীর্ঘ বিবাদ, 'কফন সত্যাগ্রহ', স্থানীয় নেতৃত্বের গ্রে প্তার, এবং সেখান থেকে পুলিশ-আন্দোলনকারীর হিং স্র কন ফ্র ন্ট। জ খম দুপক্ষের ভেতর শেষমেশ নিহ তের তালিকায় নাম চার আন্দো লনকারী গ্রামবাসীর। অথবা খুব টাটকা ২০১৮-র কু খ্যা ত স্টারলাইট কপার স্মেল্টিং কারখানা এবং তার লাগাতার পরিবেশ-পরিপন্থী চেহারা। ১৯৯৭-এর সালফার ডাইঅক্সাইড গ্যাস লি ক, এবং সেখান থেকে একশ'র কাছাকাছি মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা। ২০১৩-র প্রায় ৮৪টি গ্যাস লি কের ঘটনা। এবং ২০১৮। সেই স্টারলাইট নিজেদের ক্ষমতা বছরে ৪ লক্ষ থেকে ৮ লক্ষ টন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রবল প্রতি বা দ তুতিকোরিনের রাস্তায়। প্রতি বাদী দের ওপর নির্বিচারে গু লি এবং ২০১৮-র ২২ থেকে ২৩ মে-র মধ্যে ১৪টি হ ত্যা। ২০২২-এর এপ্রিলে 'দ্য সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার্স অ্যান্ড পিপল'-এর রিপোর্টে অ বৈ ধ খনি আটকাতে পুলিশ ও পরিবেশকর্মী হ ত্যার পাশাপাশি বালি-উত্তোলন সংক্রান্ত উন্মুক্ত গহ্বরের কারণে দু র্ঘট না, মাইনিংরত শ্রমিকদের ডু বে যাওয়া—এইসমস্ত কারণ মিলিয়ে বালি-উত্তোলন জড়িত কারণে ২০২০-র ডিসেম্বর থেকে ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত সামগ্রিক আ হ ত ও নিহ তের সংখ্যা যথাক্রমে ৪৩৮ ও ৪১৮, এবং এই ৪১৮-র ভেতর ৪৯টি খননজনিত কারণে খোঁড়া জলবেষ্টিত গর্তে ডুবে গিয়ে দুর্ঘ টনা থেকে, ৯৫টি খননের সময় যান্ত্রিক ও অন্যান্য দুর্ঘ টনা থেকে। খননসংক্রান্ত বিভিন্ন পর্যায়ে গাড়ি দুর্ঘ টনায় নি হ ত ২৯৪, আহত ২২১। খননকার্য-জনিত সং ঘ র্ষে নি হ ত ১২, আ হ ত ৫৩ এবং এই ৫৩-র অন্তত ১০ জন আগে-পরে বিভিন্ন সময় বালি-উত্তোলন নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। ন্যাশনাল ক্রা ই ম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) আ ত্ম হ ত্যা ও দুর্ঘ টনার স্বাভাবিক তথ্য রাখলেও পরোক্ষভাবে যে দুর্ঘ টনাগুলি, বিশেষ করে পথ দুর্ঘ টনাগুলি বালি-উত্তোলন জনিত কারণে ব্যবহৃত যানবাহনগুলি থেকে হচ্ছে সেসব সাধারণ দুর্ঘ টনার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, আলাদা করে বালি-উত্তোলন খ ল নায়ক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না এনসিআরবি-র রিপোর্টে। পথদুর্ঘ টনার ৩৫টি বিভাগের কোথাও মাইনিংজনিত কারণ উল্লেখ নেই। দুঃখজনক এটাই যে, খনি এলাকার দুর্ঘ টনার একটা বিশাল সংখ্যক অংশ শ্রমিক বা স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্তানসন্ততিরা। খেলতে খেলতে তারা বুঝতে পারছে না বালির গর্ত। নদীবক্ষের এক এক জায়গায় এক এক রকমের গভীরতা থাকে। বালি উত্তোলনের বর্তমান হারে খননের জন্য বেঁধে রাখা গভীরতা ছাড়িয়ে অতিরিক্ত বালি উত্তোলন চললে সেই গভীরতার অসঙ্গতি নদীবক্ষকে ব্যবহার করা অভিজ্ঞদের পক্ষেও বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। রাখা হচ্ছে না কোনওরকম নোটিশবোর্ড। ফলত, দুর্ঘ টনার কমতি নেই। হিসেব করে দেখা গেছে, গোটা পৃথিবীতে বছরে ৫০ বিলিয়ন মেট্রিক টন বালি উত্তোলন করা হয় নদীগর্ভ থেকে, যা দিয়ে একটি ২৭ মিটার উঁচু ও ২৭ মিটার চওড়া প্রাচীর তৈরি করা যেতে পারে। 'আওয়াজ ফাউন্ডেশন' সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা পরিবেশবিদ সুমেইরা আব্দুলালির মতে, গোটা দেশে কোথাও সরকারিভাবে বালি-উত্তোলনের কোনও নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ রূপরেখা বাস্তবায়িত করা হচ্ছে না। সুমেইরা বলছেন—'আমরা অন্ধ কা রের দিকে চলেছি, উই আর মুভিং ইন ডার্ক নে স, আমরা বুঝতেও পারছি না এই নদীখাত থেকে বালি-উত্তোলনের কী ভয় ঙ্ক র পরিণ তি হতে চলেছে'। অথচ ১৯৫৭ সালের মাইন্স অ্যান্ড মিনারেলস (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন) অ্যাক্টে রাজ্য সরকারগুলিকে অ বৈ ধ বালি উত্তোলন, পরিবহণ ও সঞ্চয় আটকাতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশের পরিবেশ দপ্তরের থেকে 'সাস্টেনেবল স্যান্ড ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন', ২০১৮-য় খনি দপ্তরের থেকে 'স্যান্ড মাইনিং ফ্রেমওয়ার্ক' ইত্যাদি বলবৎ হলেও বাস্তবে, স্থানীয় স্তরে তার রূপায়নের অভাব সুস্পষ্ট। ২০১৮-য় গুজরাট সরকারের পক্ষ থেকে সবরমতী, ওরসাং, তাপি, ভাদার ইত্যাদি নদীতীরে 'ত্রিনেত্র' ড্রোন ক্যামেরা নজরদারি শুরু করার মতো বিক্ষিপ্ত কিছু উদ্যোগের মতো হাতে গোণা ঘট নার বাইরে তেমন কোনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা জানা যাচ্ছে না। অতিমারি-পরবর্তী সময়ে বেকারত্ব এবং ভেঙে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা করার সংবেদনশীল সময়ে এই বে আই নি বালি-উত্তোলন হুহু করে বেড়ে গেছে। মোহনাসংলগ্ন এলাকাগুলিতে এই বালি উত্তোলনে নদীঘাত গভীর হয়ে হুহু করে ঢুকছে লবণাক্ত জল। বালিস্থিত অণুজীব কমে গিয়ে মাটির স্বাস্থ্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াচ্ছে সবকিছু। এবং সবচেয়ে বড় কথা নদীর স্বাভাবিক গতির হেরফের ঘটছে হামেশাই। শে ষ হয়ে যাচ্ছে বিপ ন্ন ঘড়িয়াল, কচ্ছপ। পরিবেশকর্মী থেকে দায়িত্বসচেতন সৎ পুলিশ-আধিকারিকেরা যত্রতত্র আ ক্রা ন্ত হচ্ছেন। মহারাষ্ট্রের কিহিমের বালি উত্তোলন আটকাতে গিয়ে ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে দুবার প্রায়-প্রাণ ঘা তী হা ম লা হয় সুমেইরার ওপরে। প্রথম আক্র ম ণের ঠিক পরেই পরিবেশকর্মীদের ওপর লাগাতার আক্র ম ণের জন্য একজোট হয়ে কাজ করা শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠান 'মিত্রা' ('মুভমেন্ট এগেইন্সট ইন্টিমিডেশন, থ্রেট, রিভেঞ্জ এগেইন্সট অ্যাক্টিভিস্টস'), যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ সুমেইরা নিজে। ........................................ চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে (পরিবেশ সম্পর্কিত আক্র ম ণ-হ ত্যা : ইতিহাস-বর্তমান) অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য প্রচ্ছদের ছবি : অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য প্রচ্ছদ রূপায়ণ : সৌজন্য চক্রবর্তী মুদ্রিত মূল্য : ৩৯০ টাকা সুপ্রকাশ
Image from Suprokash: ১৭৩০, ১১ সেপ্টেম্বর। খেজারলি গণহ  ত্যা। রাজস্থানের মারোয়াড়ের মহারাজা অ...
❤️ 1

Comments