Suprokash
Suprokash
May 30, 2025 at 01:08 PM
এবার যাঁদের কথা বলবো, দেখতে দেখতে তাঁদের কালটা অনেক প্রাচীনত্বের দিকে চলে গেছে। এর মধ্যে প্রথম মানুষটি হলেন সমরেশ বসু। তাঁর বিষয়ে লেখাটা হয়তো খানিক বিশ্বাসঘাতকতা হবে। কারণ, তাঁকে কথা দিয়েছিলাম তাঁর বিষয়ে কোনদিন কিছু লিখব না। তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করার সময় লেখালেখির মধ্যে ছিলাম না, সুতরাং কথাটা দিতে অসুবিধে বোধ করিনি। তিনি বলেছিলেন, যদি কিছু লিখিস বানিয়ে লিখিসনে যেন কিছু। সেই কথাটিই তাঁকে দিয়েছিলাম। সুতরাং বিশ্বাসঘাতকতা কথাটা হয়তো এক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয় না। জিজ্ঞেস করেছিলাম, লিখতে বারণ করছো কেন? তাছাড়া আমি তো লিখিই না । —তোমার মধ্যে একটা লেখার প্রবণতা আছে বলে মনে হয় আমার। তাই আগেভাগেই বলে রাখছি। নইলে কী লিখতে কী লিখবে, আমার কথা লেখার জন্যে অনেকেরই হাত চুলবুল করে তো। যত সম্ভাব্য অসম্ভাব্য চুটকুলা আর মুখরোচক কেচ্ছাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। দুশ্চরিত্র, মদ্যপ বলে খ্যাতি আছে তো আমার। —তার জন্য তুমি নিজেও কম দায়ি নও। তোমার লেখাগুলিই দুশ্চরিত্র হিসাবে তোমার প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অতো প্রেমের কাহিনি, তার কিছু কি আর ‘ঘটনা’ নয়? মানুষ হয়তো এমন ভাবে। —তোর কথাটা কী? তুই তো আমার সব লেখা পড়েছিস বলছিস।মিশছিসও অনেকদিন থেকে। কালকূটের অভিজ্ঞতার বাস্তব প্রমাণও তোর কম নয়। —আমার মনে হয়, তোমার মধ্যে সেক্স্ ফ্যান্টাসির একটা মস্ত বড়ো ব্যাপার আছে। —তা আছে। তবে সেটা কোন লেখকের মধ্যে নেই? ব্যাপারটা যখন কালকূট হিসাবে লিখি তখন প্রেমের একটা মহিমান্বিত রূপ প্রকাশ করার প্রচেষ্টা থাকে। কালকূট কখনো উপভোগে মত্ত হয় না, ভোগে স্নিগ্ধ থাকে। সমরেশ বসুর ব্যাপারটা আলাদা, সে ব্যাটার বাস্তবের প্রতি নিষ্ঠ থাকার দায় আছে। —দায়টা কার কাছে? —প্রথমত নিজের কাছে কনফেশনের প্রশ্নে, দ্বিতীয়ত পাঠকদের কাছে অতি-আর্ট এবং ভণ্ডামিমুক্ত থাকার স্বার্থে। —কনফেশান কেন? কোনো কাজের জন্য কি পাপবোধে ভোগো? —পাপবোধে যারা ভোগে না, তারা ক্রিমিনাল, অন্তত সাইকোলজিক্যালি। কথাগুলো মোটামুটি এরকম ভাবেই হয়েছিল রূপনারায়ণের কূলের সেচ বিভাগের এক বাংলোর বারান্দায় বসে এক বর্ষণমুখর সকালে। অনেকে মিলে গিয়েছিলাম। আগের রাতে যথেচ্ছ ইলিশ মাছ, খিচুড়ি এবং ‘রম্’ এর কল্যাণে বাকি সবাই তখনো ঘুমে বিভোর। সমরেশদা আর্লি রাইজার। অভ্যাসটা আমারও। প্রাতঃকৃত্য সেরে দুজনে নিরুপদ্রবে হাল্কা কথাবার্তা কইছিলাম। জায়গাটির নাম ‘দেনান’। প্রকৃতি এখানে অকৃপণ। বাংলোর আশেপাশে বিরাট এলাকা নিয়ে পাঁচিল ঘেরা বাগান। বিশাল বিশাল গাছ, বেশ সযত্ন পরিচর্যায় প্রতিপালিত। সামনে রূপনারায়ণ তার বিরাট বিস্তার নিয়ে বিরাজমান। সার্থকনামা নদ। জীবজগতে নাকি পুরুষ প্রাণী স্ত্রী প্রাণী অপেক্ষা সুন্দরতর। এমন-কি মানুষের ক্ষেত্রেও। নদী এবং নদের ক্ষেত্রে সাধারণত এই নিয়মটি অন্তত খাটে না। আমার কাছে নদ বলতে অজয়, দামোদর ইত্যাদি। তাদের কখনোই আমার দর্শনধারী বলে মনে হয়নি। কিন্তু রূপনারায়ণ তা নয়। তার মধ্যে যেমন একটা ম্যাচো ভাব, তেমনই ক্লান্ত স্বভাব। এছাড়া নদীই আমার কাছে আকর্ষণের। তার প্রেমিকা সত্তাটি আমাকে বড় মজায়। এখানে প্রকৃতির বিস্তারটি প্রকৃতই উদার। সমরেশদা তাঁর লেখালেখিতে প্রকৃতিকে মানুষের পরিমণ্ডল ব্যতিরেকে ব্যবহার বিশেষ করেন না বলেই আমার ধারণা। কিন্তু তাঁর স্বভাবে প্রকৃতি-প্রিয়তা বড় ব্যাপক। মানুষটি প্রকৃতিকে আকণ্ঠ-আস্বাদে ভোগ করেন। ব্যাপার আরও সত্য মনে হয়েছিল যখন অনেকক্ষণ কথাবার্তা কইবার পর, দুজনেই বিপুল বর্ষণের মধ্যে গাছেদের প্রায় নৃত্যরত দেখছিলাম এবং মৌন ভঙ্গ করে বলেছিলাম—একটা গান গাও। সমরেশদা কিছুকাল নাকি দস্তুর মতো না হলেও শিখেছিলেন। আমার অনুরোধটা পরিবেশের সমর্থন পেয়েছিল। প্রথমেই তিনি শোনালেন, ‘বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি।’ গলা অসাধারণ নয়। তবে সুরে আছে এবং তাঁর আবেগ পরিবেশ ও গানের বাণীর সঙ্গে একাকার হয়ে অনবদ্য লেগেছিল। আমি ভুলভাল সুরে অজস্র গান গাইতে পারতাম। সমরেশদাকে আগে শুনিয়েও ছিলাম। সেদিনও গেয়েছিলাম তাঁর নির্দেশে। অতুল প্রসাদী টপ্পা—‘তাহারে ভুলিবি বল কেমনে।’ পরিবেশ মজিয়েছিল দুজনকেই। সুরের শুদ্ধাশুদ্ধি কাউকেই বিব্রত করেনি। মনে বড় আবেগ ছিল দুজনেরই। সেদিন রাতের পানভোজনের পর দলের সবাই ঘুমোলে সমরেশদা বলেছিলেন, ইলিশ মাছ ধরা দেখেছো কখনো রাতের বেলায়? জেলেদের ডিঙিতে চেপে? বলেছিলাম, ছোটবেলায় দু’একবার দেশের বাড়িতে। —দেশ কোথায় ছিল? —বরিশালে। —চলো আজ রূপনারায়ণের মাঝিদের সঙ্গে দেখি। বলা যায় না, হয়তো বরিশালের কোনো জেলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েও যেতে পারে। উদ্বাস্তু হয়ে কতই তো এসেছে এপারে। সেদিন এক চমৎকার অভিজ্ঞতা এবং সম্পর্কের উষ্ণতায় রাতটা কেটেছিল। এই ঘটনার কাহিনিটা আমি একটা ছোট পত্রিকায় ভিন্নভাবে লিখেছিলাম। এখন বিস্তারিত আবার লিখছি। আগের লেখাটা হয়তো দু’চারজন পড়ে থাকলেও থাকতে পারেন। বরং একটা বড় লেখার মধ্যে কাহিনিটা ধরা থাকুক—এমন ভাবছি এখন । সমরেশদার সঙ্গে সেদিন আগেভাগে কথাবার্তা হয়েছিল। রাতে সঙ্গের সাথীরা সারাদিনের হুল্লোড় এবং মদ্য প্রভাবে রাত এগারটার মধ্যেই ঘুমে কাদা। সমরেশদার নিয়মিত পানাভ্যাস ছিল, সুতরাং ছন্দপতন ঘটাতেন না। আমার তখন সবে মদ্য-প্রাশন ঘটেছে। সুতরাং মনে ভয় এবং পাপবোধ দুটোই। ব্যাপারটা বিতাং বলার হেতু এই যে বরাবর একটা রটনা শুনে এসেছি যে সমরেশদার নাকি মাত্রাজ্ঞান নেই, সময় অসময়ের ঠিক নেই, কাছাকোঁচার পর্যন্ত সাব্যস্ততা থাকে না, তিনি নাকি এমনই দরের একজন পানাসক্ত ব্যক্তি। আমি অবশ্য আমার সুদীর্ঘ সাহচর্যে কোনোদিন তাঁর এমন অবস্থা দেখিনি। তাঁর প্রথম যৌবন কালে কী করেছেন সেটা অবশ্য জানা নেই। তখন আমার বয়সটা তাঁর সঙ্গী হওয়ার উপযুক্ত ছিল না। অতএব, আমাদের দেহমন ফুরফুরে থাকলেও ইন্দ্রিয় তথা প্রত্যঙ্গ নিচয় যথা স্বাভাবিকই ছিল। আমার মধ্যে একটা ভিন্ন উন্মাদনা কাজ করছিল। জানতাম ‘গঙ্গা’ উপন্যাসটি লেখার আগে তিনি দীর্ঘদিন জেলেদের সঙ্গে তাদের কঠিন জীবনের সঙ্গী হয়ে শুধু ক্ষেত্রকর্ম করেছিলেন। উপন্যাসটির বাস্তবতা সেই বিষয়ে ব্যাপক সাক্ষ্য দেয়। লোকজীবনের কত মহৎ উপন্যাস রচনা করার জন্যই যে তিনি এরকম কঠোর বাস্তবতার মধ্য দিয়ে গেছেন। অনেক দূরে গুটি গুটি ভাসমান ডিবড়ির আলো দেখা যাচ্ছিল। ওগুলো আসলে ইলিশ ধরা নৌকোর ডিবড়ির আলো। নৌকাগুলো অন্ধকারে ঠাহর হয় না, শুধু আলোগুলোকে মনে হয় যেন তারা জলের মধ্যে ভাসছে। একটা আলো খানিক কাছাকাছি আসলে সমরেশদা মুখের দু’পাশে হাতদুটো চোঙা মতন করে একটা তীব্র আওয়াজ করলেন। এ আওয়াজ জেলেরা বোঝে। নৌকো থেকে তাই একই তীব্রতায় প্রতি আওয়াজ এলো একটা। সমরেশদা বললেন, হবে হে আমাদের মাছধরা দেখা হবে। বললাম, কী করে বুঝলে? —না হলে আওয়াজটা অন্যসুরে দিয়ে, নৌকো মাঝের দিকে চালিয়ে দিত। আওয়াজটা শিখেছিলাম সেই ‘গঙ্গা’র সময়ে, ব্যাপারটায় খানিক মন্ত্রগুপ্তি আছে। না শিখলে, না জানলে, এমনি হবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি লম্বাটে নৌকোর ছুচোলো মুখ জলের প্রান্তে এসে লাগলো। আকাশে তখন বর্ষা রাতের মেটে জোছনা। সারাদিন বৃষ্টি গেছে, খুব তাড়াতাড়ি আর বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু জলের কিনারে পৌঁছোতে অন্তত শ’তিনেক মিটার কাদা পেরিয়ে যেতে হবে। সমরেশদা বললেন, পারবে? ব্যাপারটা কিন্তু সহজ না। বললাম, আমার কথা ছাড়ো। আমার জেলায় সন্তানেরা মাতৃগর্ভ থেকে সরাসরি কাদায় পড়ে। তুমি যখন গঙ্গা মাটির কাদায় জীবন দর্শন করেছিলে, সেটা ছিল তোমার ভাবের দশায় কাদাঘাটা, আমি তখন কোমর অবধি প্যাঁকে ডুবিয়ে চ্যাঙ, পাঁকাল, বান মাছ ধরার নামে জীবনের দুঃখ হাতড়াতে শুরু করেছি। বয়স তখন দশ কি এগারো। আমায় কাদা চিনিও না। —আরে আমিও বাঙাল বাচ্ছা মূলত। —সে তো ঢাকাই বাঙাল। বরিশালে যদি কোনো কালে একটা বর্ষণ কাটাতে না হয় কথা ছিল। আমি পূর্ব বাংলার সর্বাধিক নদী, বিল, বাওড়ের জিলার ছেলে ছিলাম। দশ বারো বছর বয়স থেকে মাছধরা দেখতে এবং মাছ ধরতে, খাল, বিল, নদী বাওড়ে জেলেদের সঙ্গে রাত কাটিয়ে ভোর রাতে বাড়ি এসে বাবার বিদ্যেসাগরি চটি বা কাষ্ঠ খড়মের আস্বাদ যে কত করেছি তার কি শেষ আছে? অবশ্য সেই মাছের ভাগ যা পেতাম, তা বাবা খেতেন না এমনও নয়। সুতরাং সমরেশদাকে একেবারে তুবড়িতে যেন উড়িয়ে দিলাম। মাঝি আওয়াজ দিলে। কাপড় গুটিয়ে চটি হাতে দু’জনেই থপাস্ থপ্, থপাস্ থপ্ চলছি তো চলছি। দু’জনেরই কাঁধে ঝোলা। সমরেশদারটা একটু যেন ভারী। সে রাতের নৌকোভ্রমণ খুবই উপভোগ্য হয়েছিল, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। মনে উত্তেজনাটা ছিল একজন বিখ্যাত এবং বিতর্কিত লেখকের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় অতিবাহিত করার। প্রকৃতির ব্যাপারটা তো ছিলই। তাঁর সঙ্গে কাছে দূরে কম জায়গায় ঘুরিনি। কিন্তু রূপনারায়ণের এই বেড়ানোটার মত বেড়ানো আর ঘটেনি। বর্ষাকালের রাত ছিল সেদিন। শুক্লপক্ষ হলেও জোছনার প্রাবল্য ছিল না মোটেই। বৃষ্টি হচ্ছিল না বটে, তবে আকাশে মেঘের আনাগোনা যথেষ্টই ছিল। ফলে কখনো মেঘ কখনো চাঁদের আলো একটু ভিন্ন প্রাকৃতিক আবহ তৈরি করছিল। নৌকায় উঠে কী কায়দায় বসে পায়ের কাদা সাফ করতে হয়, দেখলাম সেসব কায়দা কানুন তাঁর রপ্তে দিব্য আছে। নৌকায় জুৎকরে বসে, থলে থেকে একটি বেশ বড়ো মাপের পেটমোটা বোতল বের করে জেলেদের মধ্যে যে বয়োজ্যেষ্ঠ তার হাতে দিয়ে বললেন, জল, পাত্র এসব আছে তো? —আইজ্ঞা।—তার উত্তর। আমি ‘আইজ্ঞা’ শুনে বুঝলাম তিনি পূর্ব বাংলার। নৌকায় তিনজন জেলে। তাদের একজন কিশোর প্রায়। সমরেশদা বললেন, তোর খেয়ে কাজ নেই। এখনো গোঁফ গজায়নি। বড় দুজন কিশোরটির হাতে ‘খুট’ ধরিয়ে চারটি নারকেলের মালা বের করে বললেন, এতে চলবেন, বাবু? এছাড়া তো পাত্তর নাই আইজ্ঞা। সমরেশদা বললেন, খুব চলবে। কিন্তু ‘বাবু’ ডাকটা চলবে না। আমার নাম এই, খুব অস্বস্তি লাগলে সঙ্গে একটা ‘দা’ যোগ করতে পার। এবার তোমাদের নামগুলো বলে ফেলো তো কত্তা। —মোরে কত্তা কলেন? মুই কি কত্তা ডাকের যুগ্যি? সময়টা ছিল আশির দশকের গোড়ার দিকের। তখনও নিম্ন কোটির তথা অবহেলিত জাতের মানুষদের সামাজিক সম্মান তেমন প্রশংসনীয় স্তরে ওঠেনি। নিজেদের আত্মসম্মান বিষয়ে তাদের নিজেদেরই অবস্থান ছিল নড়বড়ে যা এখনো যে পুরোটা গেছে এমন নয়। সমরেশদা মানুষের সম্মান বিষয়ে খুব সতর্ক সচেতন মানুষ ছিলেন। ফাঁকা বুলি দিয়ে ‘আমার তোমার মধ্যে কোনো প্রভেদ নাই’ গোছের বাণী দিয়ে, লোক দেখানো উদারতার মধ্যে তাঁকে কখনো দেখিনি। যখন যে সমাজের মানুষের সঙ্গে মিশতেন তাদের রীতি কানুনটা রপ্ত করে নিতেন খুব দ্রুত। তারা যেমন সহজ সেই সহজতায় চলে যেতে পারত অক্লেশে। তিনি তাদের বরং বলতেন, দেখো, আমাদের তোমাদের মধ্যে তফাত আছেই। সেটা যাতে আমরা উভয় তরফ থেকে আস্তে আস্তে কমিয়ে শেষ করতে পারি সেই চেষ্টাটাই করা উচিত। এর জন্যে হয়ত সময় লাগবে, তবে এ পাপ ঘুচবেই একদিন । আমি অবাক হচ্ছিলাম নৌকোর জেলেরা সমরেশদা আর আমাকে অত সমাদরে নিল কেন এবং কোনো প্রশ্ন না তুলেই? আমরা কারা, কোত্থেকে এসেছি, আমাদের উদ্দেশ্য কী— কিছুই তো তারা জানতে চাইল না। সমরেশদা নৌকোর গলুই-এ বসে পা ধুতে শুরু করার আগে একবার বলেছিলেন যে আমরা একটু তাদের সঙ্গে ভেসে ভেসে মাছ ধরা দেখতে চাই । বাস, তারা অমনি রাজি হয়ে গেল? শুধু বলল, সে আর এমন কী কথা, তবে এ বড়ো কষ্টের ব্যাপার। আপনারা শহর নগরের বাবু মানুষ কাদা প্যাকে পা ডুবোয়ে আলেন, না বলবো না। তবি বড়ো কষ্টডা হবেনে আপনাদের। এইমাত্র কথা। বয়স্ক লোকটি বাবা, অন্য দু’জন তার দু’ছেলে। সমরেশদা নাম জিজ্ঞেস করলে বয়স্ক লোকটি জানাল তার নাম গাঙ্গুরী দাস, বড় ছেলে বলা বা বলরাম দাস এবং কিশোরটি ছোটছেলে নাম সুবল দাস। গাঙ্গুরী নামটি বেশ । পুরো নামটা হলো গাঙ্গুরীপদ দাস। গঙ্গাপদ নামটি শোনা যায়, কিন্তু গাঙ্গুরী নামটা একেবারেই অভিনব। সমরেশদাকে বললাম, তুমি যদি এরকম একটা পটভূমিকা নিয়ে লেখায় এই নামটা ব্যবহার করতে, ভাবতাম তুমি ব্যাপারটা বানিয়ে ইচ্ছাপূরণ করেছ। কিন্তু সঙ্গে থেকে তো জানলাম এইসব ব্যাপারস্যাপার বাস্তবেও কতো কাকতালীয় হয়। সমরেশদা বললেন—বাস্তবের মজাটাই তো ওখানে। সে সব সময়ই কল্পনাকে ডিঙিয়ে যায়। তবে সাহিত্যে বাস্তবের ব্যবহারটা গল্পের মোড়কে না করতে পারলে ‘গাঙ্গুরী’কে উপন্যাস বা গল্পের চরিত্র করা যায় না। কিন্তু এসব আলোচনা এখানে করলে আমাদের এই রাতটা নীরস হয়ে যাবে। তাছাড়া ব্যাপারটা উপস্থিত যাদের সঙ্গে আমরা আছি তাদের জন্য সম্মানজনকও নয়। এই হচ্ছে সমরেশদার সাধারণের সঙ্গে মেলামেশার বিবেচনা। অন্য অনেক ক্ষেত্রেই সমরেশদা অনাবশ্যক ভাবে সাহিত্যিক আলোচনা টাল খাইয়ে দিতেন। সেদিন নৌকোর মানুষদের এই মানুষটির স্বরূপ বুঝতে কিছুমাত্র সময় লাগেনি। এই সব কথার স্মৃতিচারণ করছি একারণে যে আমার নিজের বরাবরের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল সমরেশ বসু কীভাবে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় চরিত্রগুলোকে মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে নির্বাচন করতেন, তার রহস্য জানা। তাদের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রয়োজন ছিল। অবশ্য জানতাম যে একসময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন এবং বস্তি এলাকায় থাকতেন, শ্রমিকদের মধ্যে। তাছাড়াও মানুষের সঙ্গে বিশেষ করে সাধারণবর্গের মানুষদের সঙ্গে মিশবার একটা সহজাত প্রবণতা তাঁর ছিল, যা তিনি পেয়েছিলেন তার কঠোর জীবনসংগ্রাম তথা শিল্পীসত্তা থেকে । জেলেদের মাছধরা সেদিন মাথায় উঠেছিল। সমরেশদা জেলেদের জীবনেরই নানা গল্প করছিলেন। গাঙ্গুরী দাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কত্তা, কাত্তিক, নরেন, শীতল এদের সঙ্গে পরিচয় ছিল কোনোকালে? ওরা একসময় গঙ্গায় মাছ ধরতো। অনেকদিন হয়ে গেলে, জানি না কে আছে কে নেই, বা কেমন আছে। গাঙ্গুরী বলেছিল, তা আর চিনিনে, তারা যে আমাদের আপ্তজন। আমরা হলেম গে জলের মানুষ। বাড়ি যেখানেই হোক দেখা কখনো না কখনো তো হবেই। এই ধরেন এক খ্যাপ মারতি যদি রায় মঙ্গলে গিয়ে পড়ি, সেখানে দেশ গাঁয়ের দুচারজনের সঙ্গে দেখা হবেই। —ওপারের কোথাকার লোক তোমরা? —সাতক্ষীরের শ্যামনগর। একাত্তরের যুদ্ধে এদিকে আসতি হলো। কার্তিক, নরেন, শেতল ওরা হল্য গিয়ে আপনার হাসনাবাদ বসিরহাটের দিকের লোক। তবে আসল কথা কী জানেন, জেলেগার বাড়িঘর যেখানেই হোক, আসল ঘর মোহনায়। ঘুরে ফিরে সেখানে সবার সাথি দেখা হবেই। মোহনায় আসল ঘর। বাঃ! কথাটি তোমার বেশ, কত্তা, সমরেশদা কথাটি উচ্চারণ করে বেশ কিছুক্ষণের জন্য মৌন হয়ে গেলেন। গাঙ্গুরী সমরেশদার হাতে একটি হুঁকো ধরিয়ে দিয়ে ছেলের সঙ্গে পানে ব্যস্ত। সুবল খুঁট ধরে আছে। একটাও মাছ পড়েনি। কিন্তু সে নিয়ে কারুরই কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আমি বোকার মত চুপচাপ বসেছিলাম। গাঙ্গুরী আমার অবস্থাটা বুঝে একটা নারকোল মালার পাত্র ‘রমপূর্ণ’ করে দিতে চাইলে আপত্তি জানালাম। আমার দৌড় এক আধচুমুক পর্যন্ত। সে কোটা সন্ধ্যা বেলায়ই শেষ হয়ে গেছে। সমরেশদার যেন বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। তাঁর এরকম ভাবের ঘোরের সময় আমরা যারা সঙ্গে থাকি, তারা সাধারণত বিরক্ত করি না। ততদিনে বুঝে গেছি ভ্রমণে বেরোলে এইসব মুহূর্তগুলো তাঁর প্রকৃত সম্ভোগের সময়। তাঁর কথায় ‘ভ্রমণ-বিষাদের ক্ষণ’। কারণ সময় ছুটে চলেছে। এই মুহূর্তটা আর ফিরবে না। সুতরাং সর্বপ্রকারে তাকে উপভোগ করে নাও, তার নির্যাস স্মৃতিতে গেঁথে রাখো। লেখক মানুষ তো, পরে কাজে লাগাবেন। কিন্তু সেদিন এই মগ্ন উপভোগের সুযোগ তাঁকে দিলাম না। ধ্যান ভাঙিয়ে বললাম, কী ব্যাপার তেপর রাত্তিরে মাঝ গাঙে এনে ছেড়ে দিয়ে, নিজে যে ধ্যানী অমোঘসিদ্ধি হয়ে বসলে? কীরকম লোক হে তুমি? বললেন, ধ্যানী অমোঘসিদ্ধি! বেশ কথাটি বললে কিন্তু। আসলে সব ভ্রমণে, সবস্থানে, সবসময় কথাগল্প চলে না। এমন একটা, বা প্রায় অনুরূপ পরিবেশেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, ‘আমি মানব একাকী ভ্রমি, বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে।’ আমি সেই বিস্ময়ের খুদকুড়ো টুকু চেটেপুটে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এই প্রগাঢ় স্তব্ধতা, এই বিস্তীর্ণ বারিস্তিম, মাথার উপরে অনন্ত আকাশ, সর্ব-চরাচরে এই অসামান্য মৌন, এর মধ্যে কি কথা মানায়? এই উপভোগের মালিক, সর্বজীব জগতের মধ্যে একমাত্র আমি, মানুষ। কী অভিনব সৌভাগ্যের একমাত্র অধিকারী এবং তা শুধু একবারেরই জন্য। বললাম, ‘আবার যদি ইচ্ছা কর, আবার আসি ফিরে।’ বললেন, সে কি হয় আর? কি-জানি? সমরেশদা, আগেই বলেছি, খুব সুকণ্ঠ না হলেও সুরে ছিলেন। বিশেষ বিশেষ সময়ে, গভীর হৃদয়াবেগের মুহূর্তে নিজের থেকেই গেয়ে উঠতেন। অনুভূত, উপলব্ধ বিস্ময়কে, আনন্দ বা বিষাদকে প্রকাশ করার উপযুক্ত গানের কলিটি ঠিক সময়ে এসে যেত তাঁর কণ্ঠে, তা যেন প্রায় ঋক্মন্ত্রের অমোঘ উচ্চারণের মতো ধ্বনিতে। তা যে রবি ঠাকুরের গানের বাণীই হতো সবসময় এমন নয়। লোকায়ত কোনো গীত বা গাথার একটি বাণীকেই হয়তো মূলাধারে রেখে, বাকিটি নিজেই বানিয়ে নিতেন। গোটা গানটি হয়তো মনে নেই। কোথায় কোন বাউল, ফকির, মাইজভাণ্ডারির আখড়া বা মাজার থেকে শোনা একটি মনমতন কলি তখন হয়ে উঠত একটি ভিন্ন গান। সুর থাকত লোকায়তই। নইলে যাদের সঙ্গে বিহার তারা মজবে কেন? সেই রকমই অবস্থায় এখন বাউল-দরাজ কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, এমন মানব জনম আর পাবে না— যদি পেয়ে গেছে মজে গেছ তারে ভোগ করে নাও ষোল আনা। দিন বৃথায় যেতে দিও না হে— শুধু কালের সাথে তালে তালে যাও হে এই মধুর ভ্রমণে পিছন থাকুক পিছে পড়ে, পিছে ফিরে থেকোনা হে পিছন পানে চেও না। ......................................... চলার পথের চলনদার মিহির সেনগুপ্ত ........................................ পুনর্বিন্যাস, সম্পাদনা : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী মুদ্রিত মূল্য : ৪৯০ টাকা সুপ্রকাশ
Image from Suprokash: এবার যাঁদের কথা বলবো, দেখতে দেখতে তাঁদের কালটা অনেক প্রাচীনত্বের দিকে ...
❤️ 1

Comments