Suprokash
Suprokash
June 21, 2025 at 09:52 AM
হ্যালো, হ্যালো, এক— দুই— তিন... হ্যালো... কিংবা—একটি ঘোষণা, আজ বৈকাল চার ঘটিকায়... নাহ্‌, সেই সুর তো কানে বাজছে না। এতো অন্য কণ্ঠ। রিক্সায় মাইক বেঁধে একটি বস্ত্রবিপণির বিপুল ছাড়ের ঘোষণা করে যাচ্ছে, কিন্তু সেই কণ্ঠ উদাত্ত, ভারী, ভরাট... নাহ, তেমন নয়, সে কণ্ঠ ছিল গোরাদার, লম্বা, ফর্সা, ঘাড়ের পিছনে অনেকটা চুল নামানো, ইউকাট—সেই সময় খুব চলত কিনা। কয়েক বছর পর শহরে ফিরেছি। চোখ ফিরিয়ে দেখলে নজরে পড়ে অনেক কিছুর বদল। তাহলে গোরাদাও কি বদলে গেল? না। গোরাদা আর নেই। সে এখন অন্য পৃথিবীতে। অথচ একটা সময় ছিল, শহরের মানুষকে কোনও কিছু জানানোর প্রয়োজন পড়লেই হালদার ইলেকট্রিক্‌সের শব্দযন্ত্র আর গোরাদার কণ্ঠ— ‘আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ। আজ সন্ধ্যা ছয় ঘটিকায় কালীমাতা হাই ইস্কুল প্রাঙ্গণে বিশ্ব বিখ্যাত যাদুকর পি সি সরকারের যাদু প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হইবে এ-এ-এ....। টিকিটের মূল্য এক টাকা, দুই, টাকা পাঁচ টাকা। আগে এলে আগে পাবেন...’ রিক্সার চাকা গড়িয়ে যায়। কিংবা ঘোষণা থামিয়ে হ্যান্ডবিল বিলি করা হয়। হলুদ রঙের সেই হ্যান্ডবিল মানুষের হাতে ধরিয়ে দেওয়াও ছিল তার কাজ। শহরবাসীর চোখ এসব দেখতে অভ্যস্ত ছিল। সেই গোরাদা নেই! অথচ সেই সময়ে মানে সত্তরের দিনগুলো শহর আর গোরাদা পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। ওই কণ্ঠের আকর্ষণে আমিও কেমন যেন আটকে যেতাম এই শহরে, গোরার সঙ্গে। তখন একটা স্কুলে মাস্টারির সূত্রে শহরে বাসা বেঁধেছি। ভাড়া বাড়ি। গ্রাম থেকে এসেছি শহরে। শহর ঠিক নয় আধা শহর। বাজার থেকে বড় রাস্তা ঢলে গেছে আমাদের ইস্কুলের দিকে। পথের পাশে ছিটেবেড়ার চায়ের দোকান। চায়ের গেলাসে চুমুক দিচ্ছি। এমন সময় একটা ভরাট কণ্ঠ এগিয়ে আসছে—‘আজ সন্ধ্যা আটটায় কলিকাতার বিখ্যাত যাত্রা কোম্পানি—নট্ট কোম্পানির যাত্রাপালা নটীই বিনোদিনী... নটী ই ই বিনোওদিনীই। শ্রেষ্ঠাংশে যাত্রারাণী বীণা দাশগুপ্ত...’ চাকা গড়িয়ে যায়। পাশ থেকে এক মাস্টারমশাই বললেন—চিনে রাখুন এ হলো আমাদের লোকাল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে। ওই মুক্তিযুদ্ধের সুবাদে আকাশবাণী বাহিত দেবদুলালের কণ্ঠস্বর গ্রামবাংলার বাতাসে ছড়িয়ে গেছে। আধা মফঃস্বলী শহরের ভরাট কণ্ঠস্বরের অধিকারী ঘোষকও সেই পদ্মশ্রী প্রাপকের তুলনীয় হয়ে গেছে মানুষের কানে কানে। সারা বছর বিবিধ ঘোষণা চলতেই থাকে। কখনও দোকান উদ্বোধন, কখনও দোকানে দামের ছাড়! এছাড়া যাত্রা, থিয়েটার, ফাংশান, সার্কাস, এবং সিনেমা—হ্যাঁ সিনেমা। এলাকার একমাত্র সিনেমা হল ‘ছবিঘর’। প্রতি শুক্রুবার গোরাদা ঘোষণা করে সবাইকে জানিয়ে দেয় কী ছবি দেখানো হবে বা হচ্ছে। সিনেমা দেয়ার সময়। ছবিঘর সিনেমা হলে এলো নতুন ছবি রাজেশ খান্না—শর্মিলা অভিনীত ‘আরাধনা’ তিনটে, ছটা নটা .... তিনটে ... ছটা.... নটা আরাধনা... আরাধনা গোরাদা কাজ করে হালদার ইলেকট্রিক্সে। মিস্ত্রি। কালি মেখে আর স্ক্রু-ড্রাইভার আর প্লাস নিয়ে কাজ করতে করতেই গলা বেচে পাঁচ টাকা রেটে। সপ্তাহে তিনদিন কাজ বাঁধা। দিন গেলে দু-তিন ঘন্টা তো বটেই। সপ্তাহ পিছু তিরিশ-চল্লিশ টাকা বাড়তি আয়। ওটা গোরার। হালদারমশাই ভাগ নেন না। তার লাভ মেশিন ভাড়া। গোরা খুব আনন্দের সঙ্গেই কাজটা করে। ও জানে লোকে ওকে দেবদুলাল বলে ডাকে। কখনও গর্বে তার বুক ভরে যায়। আবার কখনও নিজের বুকে ঘুসি মারে—ধুস্‌ আমি দেবদুলাল হতে যাবো কেন—আমি গোরা—গোরা দাস। গৌরাঙ্গ দাস। পরক্ষণেই নিজেকে বলে, যে যা বলে বলুক, খিস্তি তো মারছে না। যাক গে তোরাও আনন্দ পা—আমিও দু-পয়সা রোজগার করি। কালিমাখা প্যান্টের পাছায় হাতমুছে আবার প্লাস তুলে নেয় হাতে। .............................................. হ্যালো... মাইক টেস্টিং হ্যালো ওয়ান-টু-থ্রি সমরেন্দ্র মণ্ডল ............................................... বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১ সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত মুদ্রিত মূল্য : ৭২০ টাকা সুপ্রকাশ
Image from Suprokash: হ্যালো, হ্যালো, এক— দুই— তিন... হ্যালো... কিংবা—একটি ঘোষণা, আজ বৈকাল চ...
❤️ 1

Comments